পাশ্চাত্যদেশে জাদুঘরতত্ত্ব—মিউজিওলজি, মিউজিওগ্রাফি বা মিউজিয়াম স্টাডিজ-একটা স্বতন্ত্র বিদ্যায়তনিক বিষয় বা শৃঙ্খলা হিসেবে বিকশিত। আলেকজান্দ্রিয়ায় নাকি পৃথিবীর প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বা তার কাছাকাছি সময়ে—ঠিক নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না, আমি তখন উপস্থিত ছিলাম না-কিন্তু এটুকু দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে, সে সময়ে জাদুঘরতত্ত্ববিদদের কেউ তার ধারে-কাছে ছিলেন না। কী প্রেরণা থেকে বিশেষজ্ঞ না হয়েও একজন মানুষ এমন একটা কাজ করেছিলেন এবং দর্শনার্থীরাই বা সেখানে কোন প্রত্যাশা নিয়ে যেতেন, তা আজ ভাববার বিষয়। পৃথিবীর এই প্রথম জাদুঘরে ছিল নিদর্শন-সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার, ছিল উদ্ভিদউদ্যান ও উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা, তবে এটা নাকি ছিল মুখ্যত দর্শন-চর্চার কেন্দ্র। এ থেকে আমাদের মনে দুটি ধারণা জন্মে : জাদুঘর গড়ে উঠেছিল প্রতিষ্ঠাতার রুচিমাফিক, আর তার দর্শকেরা সেখানে যেতেন নিজের নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ অংশে, হয়ত কেউ কেউ ঘুরে ফিরে সর্বক্ষেত্রেই উপস্থিত হতেন।
কালক্রমে প্রাচীন জিনিসপত্র সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছিল এবং সম্পন্ন ব্যক্তি বা পরিবারের উদ্যোগে তা সংগৃহীত হয়ে জাদুঘর গড়ার ভিত্তি রচনা করছিল। প্রাচ্যদেশেও এমন সংগ্রহের কথা অবিদিত ছিল না, তবে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পরে পাশ্চাত্যদেশে এ ধরনের প্রয়াস অনেক বৃদ্ধি পায়। এ রকম ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জাদুঘরে কখনো কখনো জনসাধারণ সামান্য প্রবেশমূল্য দিয়ে ঢুকতে পারত বটে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সকলের জন্যে খোলা থাকত না। রাজ-রাজড়ারা বা সামন্ত প্রভুরা যেসব সংগ্রহশালা গড়ে তুলতেন, তাতে থাকতো ওইসব মহাশয়ের শক্তি, সম্পদ ও গৌরবের ঘোষণা। ষোল শতকের আগে যৌথ কিংবা নাগরিক সংস্থার উদ্যোগে জাদুঘর নির্মাণের চেষ্টা হয়নি। নবনির্মিত এসব জাদুঘরই জনসাধারণের জন্যে অবারিত হয় গণতন্ত্রের বিকাশের ফলে কিংবা বিপ্লবের সাফল্যে। ফরাসি বিপ্লবের পরে প্রজাতন্ত্রই সৃষ্টি করে ল্যুভ, উন্মোচিত হয় ভের্সাই প্রাসাদের দ্বার । রুশ বিপ্লবের পরে লেনিনগ্রাদের রাজপ্রাসাদে গড়ে ওঠে হার্মিতিয়ে। টাওয়ার অফ লন্ডনের মতো ঐতিহাসিক প্রাসাদ এবং তার সংগ্রহ যে সর্বজনের চক্ষুগ্রাহ্য হলো, তা বিপ্লবের না হলেও ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রায়ণের ফলে।
ব্যক্তিগত সংগ্রহের অধিকারীরাও একসময়ে তা জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করার প্রেরণা বোধ করেন এবং কখনো কখনো এসব ব্যক্তিগত সংগ্রহের দায়িত্বভার রাষ্ট্র গ্রহণ করে তা সকলের গোচরীভূত করার ব্যবস্থা করে। সতেরো শতকে ব্রিটেনের প্রথম পাবলিক মিউজিয়ম গড়ে ওঠে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানকার অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়মের সৃষ্টি হয় পিতাপুত্র দুই ট্র্যাডেসান্ট এবং অ্যাশমোল—এই তিনজনের সংগ্রহ দিয়ে। আঠারো শতকে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ম, তবে তার ভিত্তিও ছিল অপর তিনজনের সংগ্রহ—স্যার হ্যানস স্লোন, স্যার রবার্ট কটন ও আর্ল অফ অক্সফোর্ড রবার্ট হার্লির। এসব কথা উল্লেখ করার একমাত্র কারণ এই যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং তার পরিবর্তন যে জাদুঘরের রূপকে বড় রকম প্রভাবান্বিত করে, সে-বিষয়টা তুলে ধরা। জাদুঘরে প্রবেশাধিকার না পেলে কিংবা নাগরিকদের জন্যে জাদুঘর গড়ে না উঠলে সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না,–কেন যাব সে চিন্তা তো অনেক দূরের বিষয়। এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা যেতে পারে; পুঁজিবাদের সমৃদ্ধি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে উনিশ শতকে জাদুঘরের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও তাদের উপনিবেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। তেমনি একদিকে শিল্পোন্নতি এবং অন্যদিকে উপনিবেশবাদের অবসানের ফলে বিশ শতকে জাদুঘর-স্থাপনার কাজটি দ্রুত এগিয়ে যায়, সদ্য স্বাধীন দেশগুলোও আত্মপরিচয়দানের প্রেরণায় নতুন নতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হয় ।
এই প্রসঙ্গে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে, তার আগে আর দুটি কথা বলি। একালে আলেকজান্দ্রিয়ার মতো মেলানো-মেশানো জাদুঘরের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বোধ হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ম। সেখানে বৃহৎ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালার সঙ্গে রয়েছে বিশাল গ্রন্থাগার; স্বতন্ত্রভাবে রয়েছে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও জীববিদ্যার জাদুঘর; রয়েছে নানা বিষয়ে অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বক্তৃতার ব্যবস্থা। আর এসবের জন্যে প্রয়োজন হয়েছে প্রাসাদোপম অট্টালিকার। অভ্যাগতদের মধ্যে যিনি যেখানে যেতে চান, যা দেখতে চান ও জানতে জান, তিনি তা করতে পারেন। তবে এখনকার প্রবণতা হচ্ছে প্রাকৃতিক জগতের নিদর্শনের থেকে মানবসৃষ্ট নিদর্শন আলাদা করে রাখা, আর বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র নিয়ে ছোট-বড় জাদুঘর গড়ে তোলা । গত ত্রিশ বছরে ব্রিটেনে জাদুঘরের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, যদিও ব্রিটিশ মিউজিয়মের সমতুল্য দ্বিতীয় কোনো জাদুঘর সে দেশে তৈরি হয়নি। জাদুঘরের বৈচিত্র্য আজ খুবই চোখে পড়ে—সে বৈচিত্র্য একদিকে যেমন সংগ্রহের বিষয়গত, তেমনি গঠনগত এবং অন্যদিকে প্রশাসনগত । আজ ভিন্নভিন্ন বিষয়ের জাদুঘর গড়ে তোলার চেষ্টাই প্রবল : প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস, মানববিকাশ ও নৃতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সামরিক ইতিহাস, পরিবহণ ব্যবস্থা, বিমানযাত্রা, মহাকাশ ভ্রমণ, পরিবেশ, কৃষি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, জীবতত্ত্ব, শিল্পকলা—তারও আবার নানান বিভাগ-উপবিভাগ ৷ কোনো ব্যক্তিবিশেষের জীবন ও সাধনা সম্পর্কিত জাদুঘর বহু দেশে বহু কাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। মৎস্যাধার ও নক্ষত্রশালাও এখন জাদুঘর বলে বিবেচিত। জাদুঘর বলতে আজ আর ব্রিটিশ মিউজিয়ম, ল্যুভ বা হার্মিতিয়ের মতো বিশাল প্রাসাদ বোঝায় না । উন্মুক্ত জাদুঘর জিনিসটা এখন খুবই প্রচলিত । এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের একাংশে অবস্থিত হলেও জাদুঘরের গুরুত্ব হ্রাস পায় না। প্রশাসনের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র শ্রেণির জাদুঘরের মধ্যে রয়েছে জাতীয় জাদুঘর, স্থানীয় বা আঞ্চলিক জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ও একান্ত বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া জাদুঘর। আমাদের দেশ থেকে উদাহরণ নিলে বলব, এখানে যেমন আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, তেমনি আছে চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ঢাকার নগর জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, বিজ্ঞান জাদুঘর ও সামরিক জাদুঘর, রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, ঢাকার বলধা গার্ডেন এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের এলাকায় সাইট মিউজিয়ম। একজন কী দেখতে চান, তা স্থির করে কোথায় যাবেন, তা ঠিক করতে পারেন।
তবে জাদুঘরের একটা সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে, যা চমকপ্রদ, যা অনন্য, যা লুপ্তপ্রায়, যা বিস্ময় উদ্রেককারী— -এমন সব বস্তু সংগ্রহ করা । গড়পড়তা মানুষ তা দেখতে যায়, দেখে আপ্লুত হয়। এই প্রসঙ্গে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঢাকায় আমাদের জাতীয় জাদুঘরের প্রথম ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান। অনেক আমন্ত্রিতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিতান্ত কনিষ্ঠ শিক্ষক আমিও ছিলাম। লক্ষ করলাম, শিক্ষামন্ত্রী তাঁর ভাষণ পড়তে গিয়ে মুদ্রিত ‘জাদুঘর' শব্দের জায়গায় সর্বত্র ‘মিউজিয়ম’ পড়ছেন । চা খাওয়ার সময়ে আমাদের শিক্ষকপ্রতিম অর্থমন্ত্রী ড. এম. এন. হুদা আমাকে ডাকলেন । কাছে যেতে বললেন, ‘গভর্নর' সাহেবের একটা প্রশ্ন আছে, উত্তর দাও। গভর্নর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিউজিয়মকে আপনারা জাদুঘর বলেন কেন?' একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, 'স্যার, জাদুঘরই মিউজিয়মের বাংলা প্রতিশব্দ । গভর্নর এবার রাগতস্বরে বললেন, ‘মিউজিয়মে যে আল্লাহর কালাম রাখা আছে, তা কি জাদু?' আল্লাহর কালাম বলতে তাঁর মনে বোধ হয় ছিল, চমৎকার তুঘরা হরফে লেখা নুসরত শাহের আশরাফপুর শিলালিপি - ষোল শতকে এক মসজিদ প্রতিষ্ঠার বৃত্তান্ত সংবলিত প্রস্তরখণ্ড—সেটা রাখা হয়েছিল সকলের চোখে পড়ার মতো জায়গায়। যাহোক, গভর্নরের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, ‘স্যার, ওই অর্থে জাদু নয়, বিস্ময় জাগায় বলে জাদু —মা যেমন সন্তানকে বলে, ওরে আমার জাদু রে।' ব্যাখ্যার পরের অংশটা যথার্থ কিনা, সে বিষয়ে এখন সন্দেহ হয়, তবে আমার বাক্য শেষ করার আগেই গভর্নর হুংকার দিলেন, ‘না, জাদুঘর বলা চলবে না, মিউজিয়ম বলতে হবে, বাংলায়ও আপনারা মিউজিয়মই বলবেন।' তর্ক করা বৃথা— হুকুম শিরোধার্য করে আমি চ্যান্সেলরের সামনে থেকে পালিয়ে এলাম। যঃ পলায়েতে স জীবতি ।
আরও একটা প্রবাদ আছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আমারও তাই হলো । গভর্নরের সামনে থেকে চলে আসার
পর মনে হলো, তাঁকে বললাম না কেন, জাদু শব্দটা ফারসি, তাতে হয়ত তিনি কিছুটা স্বস্তি পেতেন। আপনারা
অনেকেই জানেন, জাদুঘর পুরোটাই ফারসি, তবে জাদুঘরের ঘরটা বাংলা। উর্দুতে জাদুঘরকে বলে আজবখানা,
হিন্দিতে অজায়েব-ঘর। খানা ফারসি; আজব, আজিব, আজায়েব আরবি। জাদু ও আজব শব্দে দ্যোতনা আছে
দুরকম : একদিকে কুহক, ইন্দ্রজাল, ভেলকি; অন্যদিকে চমৎকার, মনোহর, কৌতূহলোদ্দীপক। ‘আমার ছেলেকে
সোজা পেয়ে মেয়েটা জাদু করেছে’ আর ‘কী জাদু বাংলা গানে!'—দু রকম দ্যোতনা প্রকাশ করে।
বয়সের দোষে এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। মোনায়েম খান যে সেদিন রাগ করেছিলেন এবং জাদুঘরের অন্য অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও যে তিনি আল্লাহর কালামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, এখন মনে হয়, তার একটা তাৎপর্য ছিল। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই জাদুঘরে সংরক্ষিত মুসলিম ঐতিহ্যমূলক নিদর্শন তাঁকে আকর্ষণ করেছিল এবং বাংলায় হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে জাদুঘরকে যেহেতু ‘জাদুঘর’ বলে, তাই তিনি সেটা বর্জন করে ‘মিউজিয়ম' শব্দটি বাংলায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রয়োগ হিসেবে। জাদুঘরকে যদি তিনি আত্মপরিচয়লাভের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে থাকেন, তাহলে মোটেই ভুল করেননি। অল্প বয়সে আমি যখন প্রথম ঢাকা জাদুঘরে যাই, তখন আমিও একধরনের আত্মপরিচয়ের সূত্র সেখানে খুঁজে পাই—অতটা সচেতনভাবে না হলেও। বাংলা স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রাচীন নিদর্শনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। স্থাপত্যের নিদর্শন বলতে প্রধানত ছিল কাঠের ও পাথরের স্তম্ভ, আর ভাস্কর্য ছিল অজস্র ও নানা উপকরণে তৈরি। বঙ্গদেশে অত যে বৌদ্ধ মূর্তি আছে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না; পৌরাণিক-লৌকিক অত যে দেবদেবী আছে, তাও জানতাম না। মুদ্রা এবং অস্ত্রশস্ত্র দেখে বাংলায় মুসলিম-শাসন সম্পর্কে কিছু ধারণা হয়েছিল—ইসা খাঁর কামানের গায়ে বাংলা লেখা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পোড়ামাটির কাজও ছিল কত বিচিত্র ও সুন্দর! জাদুঘরের বাইরে তখন রক্ষিত ছিল নীল জাল দেওয়ার মস্ত বড় কড়াই। নীল-আন্দোলনের ইতিহাস কিছুটা জানতাম। কড়াইয়ের বিশালত্ব চিত্তে সম্ভ্রম জাগাবার মতো, কিন্তু তার সঙ্গে যে অনেক দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রুবিন্দু জড়িত, সেটা মনে পড়তে ভুল হয়নি। ঢাকা জাদুঘরে যা দেখেছিলাম, তার কথা বলতে গেলে পরে দেখা নিদর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে—কিন্তু বঙ্গের হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির যে নমুনা সেখানে ছিল তা থেকে আমি বাঙালির আত্মপরিচয় লাভ করেছি। পরে তা শক্তিশালী হয়েছে কলকাতা জাদুঘর ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে।
পরবর্তীকালে পৃথিবীর বহু জাদুঘরে আত্মপরিচয়জ্ঞাপনের এই চেষ্টা, নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার যত্নকৃত প্রয়াস দেখেছি। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রেকো-রোমান মিউজিয়মে ও কায়রো মিউজিয়মে যেমন মিশরের পুরোনো ইতিহাস ধরে রাখা হয়েছে, সিয়াটলে ও নর্থ ক্যারোলাইনার পূর্ব প্রান্তে দেখেছি আমেরিকার আদিবাসীদের নানাবিধ অর্জনের নিদর্শন এবং ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীদের প্রথম আগমনকালীন স্মৃতিচিহ্ন। ব্রিটিশ মিউজিয়ম এবং টাওয়ার অফ লন্ডনে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অনেকখানি ধরা আছে। কুয়েতের জাদুঘরে আমার ছেলেবেলায় দেখা ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রার সযত্ন স্থান দেখে চমৎকৃত হয়েছি; বুঝেছি, তাদের আত্মানুসন্ধান শুরু হয়েছে, কিন্তু দূর ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ হাতে আসেনি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জাদুঘরের একটা প্রধান কাজ হলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং জাতিকে আত্মপরিচয়দানের সূত্র জানানো । জাদুঘরে আমাদের যাওয়ার এটা একটা কারণ। সে আত্মপরিচয়লাভ অনেক সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রিক পরিবর্তনেরও সূচনা করে ।
টাওয়ার অফ লন্ডনে সকলে ভিড় করে কোহিনুর দেখতে। আমিও তা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন আমার আরেকটা কথা মনে হয়েছিল। জাদুঘর হৃত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জায়গা বটে, তবে তা সবসময়ে নিজের জিনিস হবে, এমন কথা নেই। অন্যের ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার হরণ করে এনেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের জাদুঘর সাজাতে কুণ্ঠিত বোধ করে না ।
তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। ব্রিটিশ মিউজিয়মে নানা দেশের নানা নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। কী উপায়ে সংগৃহীত হয়েছে, সেকথা আপাতত মুলতবি রাখলাম। কিন্তু এসব দেখে অভিন্ন মানবসত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। মনে হয়, এত দেশে এত কালে মানুষ যা কিছু করেছে, তার সবকিছুর মধ্যে আমি আছি ।
জাতীয় জাদুঘর একটা জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। যে সেখানে যায়, সে তার নিজের ও জাতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সংস্কৃতির সন্ধান পায়, আত্মবিকাশের প্রেরণা লাভ করে । এই যে শত সহস্র বছর আগের সব জিনিস-যা হয়ত একদিন ব্যক্তির বা পরিবারের কুক্ষিগত ছিল—তাকে যে নিজের বলে ভাবতে পারি, তা কি কম কথা? আবার অন্য জাতির অনুরূপ কীর্তির সঙ্গে যখন আমি একাত্মতা অনুভব করি, তখন আমার উত্তরণ হয় বৃহত্তর মানবসমাজে
জাদুঘর আমাদের জ্ঞান দান করে, আমাদের শক্তি জোগায়, আমাদের চেতনা জাগ্রত করে, আমাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে। জাদুঘর একটা শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সমাজের এক স্তরে সঞ্চিত জ্ঞান তা ছড়িয়ে দেয় জনসমাজের সাধারণ স্তরে । গণতন্ত্রায়ণের পথও প্রশস্ত হয় এভাবে। জাদুঘর শুধু জ্ঞানই ছড়িয়ে দেয় না, অলক্ষ্যে ছড়িয়ে দেয় ভাবাদর্শ। কাজেই এ কথা বলা যেতে পারে যে, জাদুঘর যেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবনার সৃষ্টি, তেমনি তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনেরও কারণ ঘটাতে পারে।
আরও একটা সোজা ব্যাপার আছে। জাদুঘর আমাদের আনন্দ দেয়। মানুষের অনন্ত উদ্ভাবন-নৈপুণ্যে, তার নিরলস সৃষ্টিক্ষমতা, তার তন্নিষ্ঠ সৌন্দর্যসাধনা, তার নিজেকে বারংবার অতিক্রম করার প্রয়াস—এসবের সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমরা অশেষ উল্লসিত হই।
এতকিছুর পরেও যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘জাদুঘরে কেন যাবে?' সূক্ষ্ম কৌতুক সঞ্চার করে প্রাবন্ধিক পরিশেষে লিখেছেন যে, তাহলে তার একমাত্র উত্তর বোধ হয় এই : ‘কে বলছে আপনাকে যেতে?’
আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও মনস্বী অধ্যাপক।। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের
১৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পিতা ডা. এ.টি.এম. মোয়াজ্জম ও মাতা সৈয়দা খাতুন। তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেছেন শিকাগো ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন । আনিসুজ্জামান উচ্চমানের গবেষণা ও সাবলীল গদ্য রচনার জন্যে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো : ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘আঠারো শতকের চিঠি’, ‘পুরোনো বাংলা গদ্য', 'বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে’, ‘বাঙালি সংস্কৃতি ও অন্যান্য’, ‘ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’, ‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি সাধক’, ‘চেনা মানুষের মুখ', ‘আমার একাত্তর’, ‘কাল নিরবধি’, ‘বিপুলা পৃথিবী ইত্যাদি। সাহিত্য ও গবেষণায় কৃতিত্বের জন্যে তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট এবং ভারত সরকারের পদ্মভূষণসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি ২০২০ সালের ১৪ই মে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।
মিউজিয়াম স্টাডিজ - জাদুঘর বা প্রদর্শনশালা সংক্রান্ত বিদ্যা ।
আলেকজান্দ্রিয়া - উত্তর মিশরের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও সুপ্রাচীন নগর। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে আলেকজান্ডার দি গ্রেট এই নগর পত্তন করেন। এটি ছিল আলেকজান্ডার যুগের গ্রিক সভ্যতার কেন্দ্র। এখানে বিশ্বের প্রাচীন গ্রন্থাগার (পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত) ছিল।
অবিদিত - জানা নেই এমন। অজানা। অজ্ঞাত
ইউরোপীয় রেনেসাঁস - খ্রিষ্টীয় চৌদ্দো থেকে ষোলো শতক ধরে ইউরোপে শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞানচর্চা ও চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে নবজাগরণের মাধ্যমে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণই ইউরোপীয় রেনেসাঁস ।
ফরাসি বিপ্লব - ইউরোপের প্রথম বুর্জোয়া বিপ্লব। ১৭৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফরাসি জনগণ সেখানকার কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ ও কারাগার দখল করে নেয় এবং সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দেয়। এর মাধ্যমে এই বিপ্লবের সূচনা হয়। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় ধনিক শ্রেণি আর অত্যাচারিত কৃষকরা ছিল তাদের সহযোগী। বিপ্লবের মূল বাণী ছিল ‘মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্পত্তির পবিত্র অধিকার।' এই বিপ্লবের ফলে সামন্তবাদের উৎপাটন হয়।
রুশ বিপ্লব - ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর বিপ্লবী নেতা লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বহারার দল বলশেভিক পার্টি সেখানকার জারতন্ত্রকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সমস্ত সম্পত্তি ও উৎপাদনের উপায়ের মালিক হয় জনগণ তথা রাষ্ট্র ।
টাওয়ার অফ লন্ডন - লন্ডনের টেমস নদীর উত্তর তীরবর্তী রাজকীয় দুর্গ। এর মূল অংশে রয়েছে সাদা পাথরের গম্বুজ। এটি নির্মিত হয় ১০৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। এক সময় দুর্গটি রাজকীয় ভবন ও রাষ্ট্রীয় কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে অস্ত্রশালা ও জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত ।
গোচরীভূত - অবগত। পরিজ্ঞাত ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় - যুক্তরাজ্যের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় । এটি প্রতিষ্ঠিত হয় বারো শতকের প্রথম
দিকে । শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সংক্রান্ত জাদুঘর অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ম এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান।
অ্যাশমল - ইংরেজ পুরাকীর্তি সংগ্রাহক। জন্ম ১৬১৭; মৃত্যু ১৬৯২। তিনি রসায়ন ও
পুরাকীর্তি বিষয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন। তাঁর সংগ্রহগুলি দিয়েই প্রতিষ্ঠিত গোচরীভূত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ম।
অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ম - ইংরেজ পুরাকীর্তি সংগ্রাহক অ্যাশমলের সংগ্রহ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর । এই সংগ্রহশালার প্রাচীন ভবন গড়ে ওঠে ১৬৭৯-১৬৮৩ কালপর্বে। বর্তমান অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৭ সালে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ম - প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাকীর্তি সংক্রান্ত এই জাদুঘর ব্রিটেনের জাতীয় জাদুঘর । প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৫৩ । সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার স্যার হ্যানস স্লোন, স্যার রবার্ট কটন, আর্ল অব অক্সফোর্ড রবার্ট হার্লি—এই তিনজন সংগ্রাহকের বই, পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, পুরাকীর্তি ইত্যাদির বিশাল ব্যক্তিগত সংগ্রহ ক্রয় করে এই জাদুঘর গড়ে তোলে ।
প্রত্নতত্ত্ব - এই বিদ্যায় প্রাচীন মুদ্রা, পুরাকীর্তি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে প্রাচীন ইতিহাস আবিষ্কার করা হয়। পুরাতত্ত্ব। archaeology।
নৃতত্ত্ব - মানব জাতির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। নৃবিদ্যা। anthropology
মৎস্যাধার - মাছ পালনের কাচের আধার। মাছের চৌবাচ্চা। জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ সংরক্ষণের কৃত্রিম জলাধার। aquarium।
ল্যুভ - Louvre Museum। ফ্রান্সের জাতীয় জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি। প্যারিসে অবস্থিত এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। এই জাদুঘরের চিত্রশিল্পের সংগ্রহ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ সংগ্রহ হিসেবে বিবেচিত ।
হার্মিটেজ - সন্ন্যাসীর নির্জন আশ্রম। মঠ। hermitage।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর - বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর। এ দেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার কাজে এটি নিয়োজিত। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের শাহবাগে এর অবস্থান।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর - এই জাদুঘর বাংলাদেশের অনন্য জাদুঘর । চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে অবস্থিত এই জাদুঘরে বাংলাদেশের পঁচিশটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বিদেশি পাঁচটি দেশের জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য রয়েছে।
ঢাকা নগর জাদুঘর - ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত এই জাদুঘর নগর ভবনে অবস্থিত। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে । এর লক্ষ্য ঢাকা নগরের ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর - এই জাদুঘর ঢাকা সংক্রান্ত বেশকিছু বই প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম জাদুঘর । মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন ও স্মারক সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্যে এই জাদুঘর বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার কাজেই জাদুঘর অনন্য অবদান রেখে আসছে।
বঙ্গবন্ধু জাদুঘর - এই জাদুঘর ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনকে ১৯৯৭ সালে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয় । এই জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক দুর্লভ ছবি, তাঁর জীবনের শেষ সময়ের কিছু স্মৃতিচিহ্ন এবং তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী প্রদর্শনের জন্যে রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞান জাদুঘর - ঢাকায় অবস্থিত এই জাদুঘরের প্রাতিষ্ঠানিক নাম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। ১৯৬৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ভৌতবিজ্ঞান, শিল্পপ্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, মজার বিজ্ঞান, ইত্যাদি গ্যালারি ছাড়াও সায়েন্স পার্ক, আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ইত্যাদি রয়েছে। এই জাদুঘর তরুণ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনামূলক কাজে প্রণোদনা দিয়ে থাকে ।
সামরিক জাদুঘর - ১৯৮৭ সালে মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে শহরের কেন্দ্রস্থল বিজয় সরণিতে এটি স্থানান্তরিত হয়। প্রাচীন যুগের সমরাস্ত্র, ট্যাংক, ক্রুজারসহ নানা ধরনের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, আঠারো শতক থেকে এ পর্যন্ত ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কামান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিভিন্ন স্মারক ইত্যাদি দেখার সুযোগ এ জাদুঘরে রয়েছে।
বরেন্দ্র জাদুঘর - প্রাতিষ্ঠানিক নাম বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ও রাজশাহীতে অবস্থিত। এ জাদুঘর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর। এখানে ভাস্কর্য, খোদিত লিপি, পাণ্ডুলিপি ও প্রাচীন মুদ্রার মূল্যবান সংগ্রহ রয়েছে। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস, শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণায় এগুলি আকর-উপাদান হিসেবে গণ্য।
বলধা গার্ডেন - ঢাকা মহানগরের ওয়ারীতে এর অবস্থান। এটি একাধারে উদ্ভিদ উদ্যান ও জাদুঘর। ভাওয়ালের জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই জাদুঘরের অনেক নিদর্শন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বলধা গার্ডেনে দেশি-বিদেশি অনেক প্রজাতির গাছপালার আকর্ষণীয় সংগ্রহ রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর - চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ কর্তৃক হস্তান্তরিত ছোট সংগ্রহ নিয়ে ১৯৭৩ সালে এই জাদুঘরের যাত্রা শুরু। এই জাদুঘরে রয়েছে টার্সিয়ারি যুগের মাছের জীবাশ্ম, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রের উৎখননকৃত শিল্পবস্তু, প্রাচীন ও মধ্যযুগের মুদ্রা, শিলালিপি, ভাস্কর্য, অস্ত্রশস্ত্র, লোকশিল্প ইত্যাদি নিদর্শন ও মুক্তিযুদ্ধের কিছু দলিলপত্র। এ ছাড়া একাডেমিক প্রদর্শনী,
দ্বিজাতি তত্ত্ব - সেমিনার ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে এ জাদুঘর সক্রিয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ভারতকে ধর্মীয় প্রাধান্যের ভিত্তিতে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার রাজনৈতিক মতবাদ। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে এ ধারণার উদ্গাতা তদানীন্তন মুসলিম লীগ নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ।
স্থাপত্য - ভবন প্রাসাদ ইত্যাদি স্থাপনের কাজ বা এ সংক্রান্ত কলাকৌশল বা বিজ্ঞান ৷ architecture |
ভাস্কর্য - ধাতু বা পাথর ইত্যাদি খোদাইয়ের শিল্প। মূর্তিনির্মাণ কলা। sculpture
কলকাতা জাদুঘর - এটি ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম বা ভারতীয় জাদুঘর নামেও সমধিক পরিচিত । কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে অবস্থিত এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৪ সালে । এটিই ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর ।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল - প্রাতিষ্ঠানিক নাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। রানি ভিক্টোরিয়ার নামাঙ্কিত স্মৃতিসৌধ। কলকাতা ময়দানের দক্ষিণ কোণে অবস্থিত সুরম্য শ্বেতপাথরে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন ।
গ্রেকো রোমান মিউজিয়ম - মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে। এতে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পুরানিদর্শনসহ প্রাচীন গ্রিক-রোমান সভ্যতার অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।
কায়রো মিউজিয়ম - মিশরের কায়রোতে অবস্থিত এই জাদুঘর মিশরীয় জাদুঘর নামেও পরিচিত। এটি ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার প্রদর্শন সামগ্রী রয়েছে।
এই রচনাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের রজতজয়ন্তী উপলক্ষ্যে শামসুল হোসাইনের সম্পাদনায় প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকা ‘ঐতিহ্যায়ন' (২০০৩) থেকে সংকলিত হয়েছে।
জাদুঘর হচ্ছে এমন এক সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান যেখানে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহ করে রাখা হয় সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার জন্যে। অর্থাৎ জাদুঘর কেবল বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিদর্শনগুলি প্রদর্শন করে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যেও সেগুলি সংরক্ষণ করে রাখে। সংগৃহীত নিদর্শনগুলিকে জাদুঘরে যথাযথভাবে পরিচিতিমূলক বিবরণসহ এমন আকর্ষণীয়ভাবে প্রদর্শন করা হয় যেন তা থেকে দর্শকরা অনেক কিছু জানতে পারেন, পাশাপাশি আনন্দও পান। এ ছাড়াও জাদুঘরে আয়োজন করা হয় বক্তৃতা, সেমিনার, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ইত্যাদির। পরিদর্শকদের মধ্যে জানার কৌতূহল বাড়িয়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য। এভাবে জাদুঘর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কিত জ্ঞান ও তথ্যের সঙ্গে জনগণকে আকৃষ্ট ও সম্পৃক্ত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গুরুত্বের কথা এবং মানব জাতির আত্মপরিচয় তুলে ধরায় নানা ধরনের জাদুঘরের ভূমিকার কথা বর্ণিত হয়েছে এই প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হয়েছে আকর্ষণীয় ঢঙে ও মনোগ্রাহী ভাষায় ।